Home ⁠ইতিহাস ও রাজনীতি জোঁক – আবু ইসহাক

জোঁক – আবু ইসহাক

by admin
জোঁক – আবু ইসহাক

জোঁক – আবু ইসহাক: লেখক পরিচিতি: আবু ইসহাক একজন কথাসাহিত্যিক। জন্মেছিলেন ১৯২৬ সালের ১ নভেম্বর তৎকালীন

মাদারীপুর (বর্তমান শরীয়তপুর) জেলার নড়িয়া থানাধীন শিরঙ্গল গ্রামে। বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মৌলভী মোহাম্মদ এবাদুল্লা ও আতহারুন্নিসা

দম্পতির ছয় সন্তানের মধ্যে আবু ইসহাক ছিলেন পঞ্চম।

আবু ইসহাক নড়িয়া থানার উপসী বিজারি তারাপ্রসন্ন ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৪২ সালে মাধ্যমিক, ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজ

থেকে ১৯৪৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিক এবং করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬০ সালে বিএ পাস করেন।

আবু ইসহাক প্রথমে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিদর্শক পদে যোগদান করেন।

দেশ বিভাগের পর ১৯৪৯ সালে তিনি পুলিশ বিভাগে সহকারী পরিদর্শক হন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে তিনি ঢাকায় এসে

জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার উপপরিচালক হন। ১৯৭৯ সালে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার খুলনা বিভাগের প্রধান হয়ে ১৯৮৪

সালে অবসর গ্রহণ করেন।

অভিধান প্রণেতা হিসেবেও আবু ইসহাকের একটি বিশিষ্ট পরিচয় আছে। তিনি সমকালীন বাংলা ভাষার অভিধান (২ খণ্ড, ১৯৯৩, ১৯৯৮)

রচনা করে বাংলা কোষগ্রন্থের পরিধিকে বাড়িয়ে তুলেছেন। তাঁর প্রণীত অভিধানের বিশেষত্ব হলো শব্দের শুধু অর্থ নয়, সব ধরনের

প্রতিশব্দ বা সমর্থক প্রদান। তাঁর অভিধানে ‘অন্ধকার’ শব্দের ১২৭টি সমার্থক শব্দ আছে।

আবু ইসহাক বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশ বিভাগ প্রভৃতি পর পর চারটি বড় ঐতিহাসিক ঘটনার পটভূমিতে ১৯৫৫ সালে

রচনা করেন তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’। পরে এই উপন্যাস একাধিক বিদেশি ভাষায় অনূদিত হয় এবং ১৯৭৯ সালে এই

উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়।

তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’ (১৯৮৬)।

এই উপন্যাসে পদ্মার বুকে জেগে ওঠা চরের শ্রমজীবী মানুষের জীবনসংগ্রামের কথা আছে। দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে এই উপন্যাস রচিত

হলেও লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি অপরিবর্তিত থাকে।

তাঁর তৃতীয়উপন্যাস ‘জাল’

এটি গোয়েন্দাজাতীয় উপন্যাস। এ ছাড়া তাঁর উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থগুলো হচ্ছে ‘হারেম’ (১৯৬২), ‘মহাপতঙ্গ’ (১৯৬৩), ‘জোঁক’ প্রভৃতি। তাঁর রচিত একমাত্র নাটক ‘জয়ধ্বনি’।

সাহিত্যকর্মে অবদানের জন্য আবু ইসহাক বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৩), সুন্দরবন সাহিত্য পদক (১৯৮১), বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ সাহিত্য পদক (১৯৯০), একুশে পদক (১৯৯৭), স্বাধীনতা পদক (মরণোত্তর, ২০০৪) ও শিশু একাডেমি পদক (মরণোত্তর, ২০০৬) লাভ করেন। ২০০৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় তাঁর মৃত্যু হয়

জোঁক – আবু ইসহাক

সেদ্ধ মিষ্টি আলুর কয়েক টুকরা পেটে জামিন দেয় ওসমান। ভাতের অভাবে অন্য কিছু দিয়ে উদরপূর্তির নাম পেটে জামিন দেওয়া। চাল যখন দুর্মূল্য তখন এ ছাড়া উপায় কী?

ওসমান হুঁকা নিয়ে বসে আর মাজু বিবি নিয়ে আসে রয়নার তেলের বোতল। হাতের তেলোয় ঢেলে সে স্বামীর পিঠে মালিশ করতে শুরু করে।

ছয় বছরের মেয়ে টুনি জিজ্ঞেস করে—এই তেল মালিশ করলে কী অয় মা?

পানিতে কামড়াইতে পারে না। উত্তর দেয় মাজু বিবি।

পানিতে কামড়ায়? পানির কি দাঁত আছে নি?

আছে না আবার। ওসমান হাসে। দাঁত না থাকলে কামড়ায় ক্যামনে?

টুনি হয়তো বিশ্বাস করত। কিন্তু মাজু বিবি বুঝিয়ে দেয় মেয়েকে-ঘাস,লতা-পাতা, কচু-ঘেঁচু পইচা বিলের পানি খারাপ অইয়া যায়। এই পানি গতরে লাগলে কুটকুট করে। ওরেই কয় পানিতে কামড়ায়।।

ওসমান হুঁকা রেখে হাঁক দেয়- কই গেলি তোতা, তামুকের ডিব্বা আর আগুনের মালশা লইয়া নায় যা। আমি আইতে আছি।

তেল নিয়ে এবার ওসমান নিজেই শুরু করে। পা থেকে গলা পর্যন্ত ভালো করে মালিশ করে। মাথা আর মুখে মাখে। সর্ষের তেল। তারপর কাতে ও ঠুকা নিয়ে সে নৌকায় ওঠে।

তেরোহাতি ডিঙিটাকে বেয়ে নিয়ে চলে দশ বছরের ছেলে তোতা।

দেখতে দেখতে পাটক্ষেতে এসে যায় নৌকা। পাট গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে ওসমানের চোখ তৃপ্তিতে ভরে ওঠে। যেমন মোটা হয়েছে, লম্বাও হয়েছে প্রায় দুই মানুষ সমান। তার খাটুনি সার্থক হয়েছে।

সে কি যেমন-তেমন খাটুনি। রোদ-বৃষ্টি মাথায় করে ক্ষেত চষো রে-ঢেলা ভাঙো রে-উড়া বাছে রে-তারপর বৃষ্টি হলে আর এক চাষ দিয়ে বীজ বোনো। পাটের চারা বড় হয়ে উঠলে আবার ঘাস বাছো, ‘বাছট’ করো। ‘বাছট’ করে

-ফ্যান আনছছ দে-দে শিগগির। জোঁক – আবু ইসহাক

তোতা মাটির খোরাটা এগিয়ে দেয়।

লবণ মেশানো এক খোরা ফেন। ওসমান পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে চুমুক দেয়। সবটা শেষ করে অস্ফুট স্বরে বলে, শুকুর আলহামদুলিল্লাহ।

ফেনটুকু পাঠিয়েছে এজন্য স্ত্রীকেও সে ধন্যবাদ দেয় অব্যক্ত ভাষায়।

এরকম খাটুনির পর এ ফেনটুকু পেটে না দিলে সে পানি থেকে উঠতেই পারে না নৌকার ওপর। এবার আউশ ধান কাটার সময় থেকেই এ দশা হয়েছে। অথচ কতই বা আর তার বয়স : চল্লিশ হয়েছে কি হয়নি।

ওসমান পাটের হাতাগুলো তুলে ধরে। তোতা সেগুলো টেনে তোলে নৌকায়। গুনে গুনে সাজিয়ে রাখে। পাট তুলতে তুলতে ওসমান জিজ্ঞেস করে ছেলেকে—কী রানছেরে তোর মা?

ট্যাংরা মাছ আর কলমি শাক।

—মাছ পাইল কই?

-বড়শি দিয়া ধরছিল মায়।

ওসমান খুশি হয়।

পাট সব তোলা হয়ে গেলে ওসমান নৌকায় ওঠে। নৌকার কানিতে দুই হাতের ভর রেখে অতি কষ্টে তাকে উঠতে হয়।

-তোমার পায়ে কালা উইডা কি বাজান? তোতা ব্যস্তসমস্ত হয়ে বলে।

-কই?

-ওই যে,  জোঁক না জানি কী। আঙুল দিয়ে দেখায় তোতা।

-জোঁকই ত রে। এইডা আবার কখন লাগল? শিগগির কাচিটা দে।

তোতা কাস্তেটা এগিয়ে দেয়। ভয়ে তার শরীরের সমস্ত লোম কাটা দিয়ে উঠেছে।

ডান পায়ের হাঁটুর একটু ওপরেই ধরেছে জোঁকটা। প্রায় বিঘতখানেক লম্বা। করাতে জোঁক রক্ত খেয়ে ধুমসে হয়ে উঠেছে।

ওসমান কাস্তেটা জোঁকের বুকের তলা দিয়ে ঢুকিয়ে দেয়। এবার একটা শক্ত কাঠি দিয়ে জোঁকটা কাতের সাথে চেপে ধরে পোচ মারে সে। জোঁকটা দু টুকরো হয়ে যায়, রক্ত ঝরাতে ঝরাতে খসে পড়ে পা থেকে।

–আঃ বাঁচলাম রে। ওসমান স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে।

-ইস, কত রক্ত। তোতা শিউরে ওঠে।

ছেলের দিকে তাকিয়ে ওসমান তাড়া দেয়, -নে, এইবার লগি মার তাড়াতাড়ি।

তোতা পাটবোঝাই নৌকাটা বেয়ে নিয়ে চলে।

জোঁক হাঁটুর যেখানটায় চুমুক লাগিয়েছিল সেখান থেকে তখনও রক্ত ঝরছে। সেদিকে তাকিয়ে তোতা জিজ্ঞেস করে, বাজান, কেমুন কইর‌্যা জোঁকে ধরল তোমারে, টের পাও নাই?

– না রে বাজান। এগুলো কেমুন কইরা যে চুমুক লাগায় কিছুই টের পাওয়া যায় না। টের পাইলে কি আর রক্ত খাইতে পারে।

জোকটা কত বড়, বাস্পসরে: জোঁক – আবু ইসহাক

—দুও বোকা। এইডা আর এমুন কী জোঁক। এর চেয়ে বড় জোঁকও আছে।

জমি থেকে পাট কেটে ফেলার পরও ঝামেলা পোয়াতে হয় অনেক। জাগ দেওয়া, কোষ্টা ছাড়ানো, কোষ্টা ধুয়ে পরিষ্কার করা, রোদে শুকাননা। এসব কাজও কম মেহনতের নয়।

পাট শুকাতে শুকাতেই চৌধুরীদের গোমস্তা আসে। এক জন কয়াল ও দাড়িপাল্লা সঙ্গে নিয়ে সে নৌকা ভিড়ায় ওসমানের বাড়ির ঘাটে।

বাপ-বেটায় শুকনো পাট এনে রাখে উঠানে।।

মেপে মেপে তিন ভাগ করে কয়াল।

গোমস্তা হাঁক দেয়- কই ওসমান, দুই ভাগ আমার নায় তুইল্যা দ্যাও।

ওসমান হাঁ করে চেয়ে থাকে।

– আরে মিয়া চাইয়া রইছ ক্যা? যাও।

– আমারে কি এক ভাগ দিলেন নি?

– হ।

– ক্যা?

– ক্যা আবার।

– দুই ভাগ পামু।

-হ দিব হনে তোমারে দুই ভাগ। যাও ছোড হুজুরের কাছে।

–হ এহনই যাইমু।

– আইচ্ছা যাইও যখন ইচ্ছা। এহন পাট দুই ভাগ আমায় নায় তুইল্যা দিয়া কথা কও।

– না দিমু না পাট। জিগাইয়া আহি।

– আরে আমার লগে রাগ করলে কী অইব, যদি হুজুর ফিরাইয়া দিতে কয়েন, তহন না হয় ফিরত দিয়া যাইমু।

ওয়াজেদ চৌধুরীর ছেলে ইউসুফ বৈঠকখানার বারান্দায় বসে সিগারেট ফুঁকছে। ওসমান তার কাছে এগিয়ে যায় ভয়ে ভয়ে। তার পেছনে তোতা।

-হুজুর, ব্যাপার কিচ্ছু বুঝতে পারলাম না। ওসমান বলে।

– কী ব্যাপার? সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে ইউসুফ।

-হুজুর, তিন ভাগ কইর‌্যা এক ভাগ দিছে আমারে।

-হ্যা, ঠিকই ত দিয়েছে।

ওসমান হাঁ করে চেয়ে থাকে।

-বুঝতে পারলে না? লাঙল-গরু কেনার জন্য টাকা নিয়েছিলে যে পাঁচশ।

ওসমান যেন আকাশ থেকে পড়ে।

-আমি টাকা নিছি! কবে নিলাম হুজুর?

-হ্যা, এখন ত মনে থাকবেই না। গত বছর কাগজে টিপসই দিয়ে টাকা নিয়েছিলে, মনে পড়ে? গরু-লাঙল কেনার টাকা দিয়েছি। এজন্য আমরা পাব দুদু ভাগ, তোমরা পাবে এক ভাগ।

–আমি টাকা নিই নাই। এই রকম জুলুম খোদাও সহ্য করব না।

যা যা ব্যাটা, বেরো, বেশি তেড়িবেড়ি করলে এক কড়া জমিও দেব না কোনো ব্যাটারে।

ওসমান টলতে টলতে বেরিয়ে যায় ছেলের হাত ধরে।

ফেরবার পথে তোতা জিজ্ঞেস করে, “বাজান কেমুন কইরা লেইখ্যা রাখছিল; টিপ দেওনের সময় টের পাও নাই? ছেলের প্রশ্নের উত্তর দেয় না ওসমান। একটা দীর্ঘশ্বাসের সাথে তার মুখ থেকে শুধু উচ্চারিত হয়—আহা-হা-রে। তোতা চমকে তাকায় পিতার মুখের দিকে। পিতার এমন চেহারা সে আর কখনও দেখেনি।

চৌধুরী বাড়ির সীমানা পার হতেই ওসমান দেখে-করিম গাজী, নবু খাঁ ও আরও দশ বারোজন চাষী এদিকেই আসছে। করিম গাজী ডাক দেয় কী মিয়া শেখের পো, যাও কই।

-গেছিলাম এই বড় বাড়ি। ওসমান উত্তর দেয়—আমারে মিয়া মাইরা ফালাইছে এক্কেবারে। আমি বলে টাকা নিছিলাম পাঁচশ-

কথা শেষ না হতেই নবু খাঁ বলে- ও, তুমিও টিপ দিছিলা কাগজে?

-হ ভাই, কেমন কইর‌্যা যে কলমের খোঁচায় কী লেইখ্যা থুইছিল, কিছুই টের পাই নাই। টের পাইলে কি আর এমন অয়! টিপ নেওনের সময় গোমস্তা কইছিল— জমি বর্গা নিবা তার একটা দলিল থাকা ত দরকার।

-হ, বেবাক মানুষেরেই এমবায় ঠকাইছে।

করিম গাজী বলে- আরে মিয়া এমন কারবারডা অইল আর তুমি ফির‌্যা চলছ?

-কী করমু তয়?

– কী করবা, খেঁকিয়ে ওঠে করিম গাজী। -চল আমাগ লগে, দেহি কী করতে পারি।

ওসমান দেখে এদের সকলের হাতে লাঠি। করিম গাজী তাড়া দেয়- কী মিয়া, চাইয়া রইছ ক্যা? আরে এমনেও মরছি অমনেও মরছি। একটা কিছু না কইর‌্যা ছাইড়্যা দিমু?

ওসমান তোতাকে ঠেলে দিয়ে বলে, তুই বাড়ি যা গা।।

তার ঝিমিয়ে পড়া রক্ত জেগে ওঠে। গা ঝাড়া দিয়ে বলে- হ চল। রক্ত চুইষ্যা খাইছে। অজম করতে দিমু না, যা থাকে কপালে।

জোঁক – আবু ইসহাক

You may also like

Leave a Comment