Home অন‍্যান‍্য নগ্ননির্জনহাত- জীবনানন্দ দাশ

নগ্ননির্জনহাত- জীবনানন্দ দাশ

by admin
গোধূলি সন্ধির নৃত্য- জীবনানন্দ দাশ

পেঁচার ধূসর পাখা উড়ে যায় নক্ষত্রের পানে—

জলা মাঠ ছেড়ে দিয়ে চাঁদের আহ্বানে

বুনো হাঁস পাখা মেলে— সাঁই-সাঁই শব্দ শুনি তার;

এক— দুই— তিন— চার— অজস্র— অপার—

রাত্রির কিনার দিয়ে তাহাদের ক্ষিপ্র ডানা ঝাড়া

বুনো হাঁস

এঞ্জিনের মতো শব্দে; ছুটিতেছে— ছুটিতেছে তা’রা।

তারপর প’ড়ে থাকে নক্ষত্রের বিশাল আকাশ,

হাঁসের গায়ের ঘ্রাণ— দু-একটা কল্পনার হাঁস;

মনে পড়ে কবেকার পাড়াগাঁর অরুণিমা সান্যালের মুখ;

উড়ুক উড়ুক তা’রা পউষের জ্যোৎস্নায় নীরবে উড়ুক

কল্পনার হাঁস সব; পৃথিবীর সব ধ্বনি সব রং মুছে গেলে পর

উড়ুক উড়ুক তা’রা হৃদয়ের শব্দহীন জ্যোৎস্নার ভিতর।

কান্তারের পথ ছেড়ে সন্ধ্যার আঁধারে

সে কে এক নারী এসে ডাকিল আমারে,

বলিল, তোমারে চাই: বেতের ফলের মতো নীলাভ ব্যথিত তোমার দুই চোখ

খুঁজেছি নক্ষত্রে আমি— কুয়াশার পাখ্‌নায়—

সন্ধ্যার নদীর জলে নামে যে-আলোক

জোনাকির দেহ হ‌তে— খুঁজেছি তোমাকে সেইখানে—

ধূসর পেঁচার মতো ডানা মেলে অঘ্রাণের অন্ধকারে

ধানসিড়ি বেয়ে-বেয়ে

সোনার সিঁড়ির মতো ধানে আর ধানে

তোমারে খুঁজেছি আমি নির্জন পেঁচার মতো প্রাণে।

শঙ্খমালা

দেখিলাম দেহ তার বিমর্ষ পাখির রঙে ভরা:

সন্ধ্যার আঁধারে ভিজে শিরীষের ডালে যেই পাখি দেয় ধরা—

বাঁকা চাঁদ থাকে যার মাথার উপর,

শিং-এর মতন বাঁকা নীল চাঁদ শোনে যার স্বর।

কড়ির মতন শাদা মুখ তার,

দুইখানা হাত তার হিম;

চোখে তার হিজল কাঠের রক্তিম

চিতা জ্বলে: দখিন শিয়রে মাথা শঙ্খমালা যেন পুড়ে যায়

সে-আগুনে হায়।

চোখে তার

যেন শত শতাব্দীর নীল অন্ধকার;

স্তন তার

করুণ শঙ্খের মতো— দুধে আৰ্দ্র— কবেকার শঙ্খিনীমালার;

এ-পৃথিবী একবার পায় তারে, পায়নাকো আর।

নগ্ননির্জনহাত- জীবনানন্দ দাশ

সারাদিন একটা বিড়ালের সঙ্গে ঘুরে-ফিরে কেবলই আমার দেখা হয়

গাছের ছায়ায়, রোদের ভিতরে, বাদামী পাতার ভিড়ে;

কোথাও কয়েক টুকরো মাছের কাঁটার সফলতার পর

তারপর শাদা মাটির কঙ্কালের ভিতর

নিজের হৃদয়কে নিয়ে মৌমাছির মতে নিমগ্ন হ’য়ে আছে দেখি;

কিন্তু তবুও তারপর কৃষ্ণচূড়ার গায়ে নখ আঁচড়াচ্ছে,

সারাদিন সূর্যের পিছনে-পিছনে চলছে সে।

একবার তাকে দেখা যায়,

একবার হারিয়ে যায় কোথায়।

হেমন্তের সন্ধ্যায় জাফরান-রং-এর সূর্যের নরম শরীরে

শাদা থাবা বুলিয়ে-বুলিয়ে খেলা করতে দেখলাম তাকে;

তারপর অন্ধকারকে ছোটো-ছোটো বলের মতে থাবা দিয়ে লুফে আনলো সে,

সমস্ত পৃথিবীর ভিতর ছড়িয়ে দিলো।

নগ্ননির্জনহাত- জীবনানন্দ দাশ

ভোর;

আকাশের রং ঘাসফড়িঙের দেহের মতো কোমল নীল:

চারিদিকের পেয়ারা ও নোনার গাছ টিয়ার পালকের মতো সবুজ।

একটি তারা এখনও আকাশে রয়েছে:

পাড়াগাঁর বাসরঘরে সব চেয়ে গোধূলি-মদির মেয়েটির মতো;

কিংবা মিশরের মানুষী তার বুকের থেকে যে-মুক্তা আমার নীল মদের

গেলাসে রেখেছিলো

হাজার-হাজার বছর আগে এক রাতে— তেম্নি—

তেম্নি একটি তারা আকাশে জ্বলছে এখনও।

হিমের রাতে শরীর ‘উম্’ রাখবার জন্য দেশোয়ালীরা সারারাত মাঠে

আগুন জ্বেলেছে—

মোরগ ফুলের মতো লাল আগুন;

শুকনো অশ্বত্থপাতা দুমড়ে এখনও আগুন জ্বলছে তাদের;

সূর্যের আলোয় তার রং কুঙ্কুমের মতো নেই আর;

হ’য়ে গেছে রোগা শালিকের হৃদয়ের বিবর্ণ ইচ্ছার মতো।

সকালের আলোয় টলমল শিশিরে চারিদিকের বন ও আকাশ ময়ূরের

সবুজ নীল ডানার মতো ঝিলমিল করছে।

ভোর;

সারারাত চিতাবাঘিনীর হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে-বাঁচিয়ে

নক্ষত্রহীন, মেহগনির মতো অন্ধকারে সুন্দরীর বন থেকে অর্জুনের বনে ঘুরে-ঘুরে

সুন্দর বাদামী হরিণ এই ভোরের জন্য অপেক্ষা করছিলো।

এসেছে সে ভোরের আলোয় নেমে;

কচি বাতাবী লেবুর মতো সবুজ সুগন্ধি ঘাস ছিঁড়ে-ছিঁড়ে খাচ্ছে;

নদীর তীক্ষ্ণ শীতল ঢেউয়ে সে নামলো—

ঘুমহীন ক্লান্ত বিহ্বল শরীরটাকে স্রোতের মতো একটা আবেগ দেওয়ার জন্য;

অন্ধকারের হিম কুঞ্চিত জরায়ু ছিঁড়ে ভোরের রৌদ্রের মতো একটা বিস্তীর্ণ

উল্লাস পাবার জন্য;

এই নীল আকাশের নিচে সূর্যের সোনার বর্শার মতে জেগে উঠে

সাহসে সাধে সৌন্দর্যে হরিণীর পর হরিণীকে চমক লাগিয়ে দেবার জন্য।

একটা অদ্ভুত শব্দ।

নদীর জল মচকাফুলের পাপড়ির মতো লাল।

আগুন জ্বললো আবার— উষ্ণ লাল হরিণের মাংস তৈরি হ’য়ে এলো।

নক্ষত্রের নিচে ঘাসের বিছানায় ব’সে অনেক পুরানো শিশিরভেজা গল্প;

সিগারেটের ধোঁয়া;

টেরিকাটা কয়েকটা মহিষের মাথা;

এলোমেলো কয়েকট বন্দুক— হিম– নিঃস্পন্দ নিরপরাধ ঘুম।

নগ্ননির্জনহাত- জীবনানন্দ দাশ

আবার আকাশে অন্ধকার ঘন হ’য়ে উঠছে:

আলোর রহস্যময়ী সহোদরার মতো এই অন্ধকার।

যে আমাকে চিরদিন ভালোবেসেছে

অথচ যার মুখ আমি কোনোদিন দেখিনি,

সেই নারীর মতো

ফাল্গুন আকাশে অন্ধকার নিবিড় হ’য়ে উঠছে।

মনে হয় কোনো বিলুপ্ত নগরীর কথা

সেই নগরীর এক ধূসর প্রাসাদের রূপ জাগে হৃদয়ে।

ভারতসমুদ্রের তীরে

কিংবা ভূমধ্যসাগরের কিনারে

অথবা টায়ার সিন্ধুর পারে

আজ নেই, কোনো এক নগরী ছিলো একদিন,

কোনো এক প্রাসাদ ছিলো;

মূল্যবান আসবাবে ভরা এক প্রাসাদ:

পারস্য গালিচা, কাশ্মীরী শাল, বেরিন তরঙ্গের নিটোল মুক্তা প্রবাল,

আমার বিলুপ্ত হৃদয়, আমার মৃত চোখ, আমার বিলীন স্বপ্ন আকাঙ্ক্ষা,

আর তুমি নারী—

এই সব ছিলো সেই জগতে একদিন।

অনেক কমলা রঙের রোদ ছিলো,

অনেক কাকাতুয়া পায়রা ছিলো,

মেহগনির ছায়াঘন পল্লব ছিলো অনেক;

অনেক কমলা রঙের রোদ ছিলো,

অনেক কমলা রঙের রোদ;

আর তুমি ছিলে;

তোমার মুখের রূপ কতো শত শতাব্দী আমি দেখি না,

খুঁজি না।

ফাল্গুনের অন্ধকার নিয়ে আসে সেই সমুদ্রপারের কাহিনী,

অপরূপ খিলান ও গম্বুজের বেদনাময় রেখা,

লুপ্ত নাসপাতির গন্ধ,

অজস্র হরিণ ও সিংহের ছালের ধূসর পাণ্ডুলিপি,

রামধনু রঙের কাচের জানালা,

ময়ূরের পেখমের মতে রঙিন পর্দায়-পর্দায়

কক্ষ ও কক্ষান্তর থেকে আরো দূর কক্ষ ও কক্ষান্তরের

ক্ষণিক আভাস—

আয়ুহীন স্তব্ধতা ও বিস্ময়।

পর্দায়, গালিচায় রক্তাভ রৌদ্রের বিচ্ছুরিত স্বেদ,

রক্তিম গেলাসে তরমুজ মদ!

তোমার নগ্ন নির্জন হাত;

তোমার নগ্ন নির্জন হাত।

শোনা গেল লাসকাটা ঘরে

নিয়ে গেছে তারে;

কাল রাতে— ফাল্গুনের রাতের আঁধারে

যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ

মরিবার হ’লো তার সাধ;

বধূ শুয়েছিলো পাশে— শিশুটিও ছিলো;

প্রেম ছিলো, আশা ছিলো— জ্যোৎস্নায়– তবু সে দেখিল

কোন্ ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেল তার?

অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল— লাসকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার।

এই ঘুম চেয়েছিলো বুঝি!

রক্তফেনামাখা মুখে মড়কের ইঁদুরের মতো ঘাড় গুঁজি

আঁধার ঘুঁজির বুকে ঘুমায় এবার;

কোনোদিন জাগিবে না আর।

‘কোনোদিন জাগিবে না আর

জানিবার গাঢ় বেদনার

অবিরাম— অবিরাম ভার

সহিবে না আর—’

এই কথা বলেছিলো তারে

চাঁদ ডুবে চ’লে গেলে— অদ্ভুত আঁধারে

যেন তার জানালার ধারে

উটের গ্রীবার মতো কোনো এক নিস্তব্ধতা এসে।

তবুও তো পেঁচা জাগে;

গলিত স্থবির ব্যাং আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে

আরেকটি প্রভাতের ইশারায়— অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে।

টের পাই যূথচারী আঁধারের গাঢ় নিরুদ্দেশে

চারিদিকে মশারির ক্ষমাহীন বিরুদ্ধতা;

মশা তার অন্ধকার সঙ্ঘারামে জেগে থেকে জীবনের স্রোত ভালোবাসে।

রক্ত ক্লেদ বসা থেকে রৌদ্রে ফের উড়ে যায় মাছি;

সোনালি রোদের ঢেউয়ে উড়ন্ত কীটের খেলা কতো দেখিয়াছি।

ঘনিষ্ঠ আকাশ যেন— যেন কোন্ বিকীর্ণ জীবন

অধিকার ক’রে আছে ইহাদের মন;

দুরন্ত শিশুর হাতে ফড়িঙের ঘন শিহরণ

মরণের সাথে লড়িয়াছে;

চাঁদ ডুবে গেলে পর প্রধান আঁধারে তুমি অশ্বত্থের কাছে

এক গাছা দড়ি হাতে গিয়েছিলে তবু একা-একা;

যে-জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের— মানুষের সাথে তার হয়নাকো দেখা

এই জেনে।

অশ্বত্থের শাখা

করেনি কি প্রতিবাদ? জোনাকির ভিড় এসে সোনালি ফুলের স্নিগ্ধ ঝাঁকে

করেনি কি মাখামাখি?

থুরথুরে অন্ধ পেঁচা এসে

বলেনি কি: ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে

চমৎকার!

ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার!’

জানায়নি পেঁচা এসে এ তুমুল গাঢ় সমাচার?

জীবনের এই স্বাদ– সুপক্ব যবের ঘ্রাণ হেমন্তের বিকেলের–

তোমার অসহ্য বোধ হ’লো;

মর্গে কি হৃদয় জুড়োলো

মর্গে— গুমোটে

থ্যাঁতা ইঁদুরের মতো রক্তমাখা ঠোঁটে।

শোনো

তবু এ মৃতের গল্প; কোনো

নারীর প্রণয়ে ব্যর্থ হয় নাই;

বিবাহিত জীবনের সাধ

কোথাও রাখেনি কোনো খাদ,

সময়ের উদ্বর্তনে উঠে এসে বধূ

মধু— আর মননের মধু

দিয়েছে জানিতে;

হাড়হাভাতের গ্রানি বেদনার শীতে

এ-জীবন কোনোদিন কেঁপে ওঠে নাই;

তাই

লাসকাটা ঘরে

চিৎ হ’য়ে শুয়ে আছে টেবিলের ’পরে।

জানি— তবু জানি

নারীর হৃদয়— প্রেম— শিশু— গৃহ– নয় সবখানি;

অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়—

আরো-এক বিপন্ন বিস্ময়

আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে

খেলা করে;

আমাদের ক্লান্ত করে

ক্লান্ত— ক্লান্ত করে;

লাসকাটা ঘরে

সেই ক্লান্তি নাই;

তাই

লাসকাটা ঘরে

চিৎ হ’য়ে শুয়ে আছে টেবিলের ’পরে।

তবু রোজ রাতে আমি চেয়ে দেখি, আহা,

থুরথুরে অন্ধ পেঁচা অশ্বত্থের ডালে ব’সে এসে

চোখ পাল্টায়ে কয়: ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে?

চমৎকার!

ধরা যাক্ দু-একটা ইঁদুর এবার—’

হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজো চমৎকার?

আমিও তোমার মতো বুড়ো হবো— বুড়ি চাঁদটারে আমি ক’রে দেবো

কালীদহে বেনোজলে পার;

আমরা দু-জনে মিলে শূন্য ক’রে চ’লে যাবো জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার।

You may also like

Leave a Comment