Home অন‍্যান‍্য বনলতা সেন-জীবনানন্দ দাশ

বনলতা সেন-জীবনানন্দ দাশ

মৃত্যুর পর থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর শেষ ধাপে তিনি জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেন

by admin
সুরঞ্জনা-জীবনানন্দ দাশ

বনলতা সেন-জীবনানন্দ দাশ: জীবনানন্দ দাশ (Jibanananda Das) ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৮ ফেব্রুয়ারি (৬ ফাল্গুন, ১৩০৫ বঙ্গাব্দ) বর্তমান বাংলাদেশের বরিশাল জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাংলা কবি। তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অগ্রগণ্য। বনলতা সেন-জীবনানন্দ দাশ মৃত্যুর পর থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর শেষ ধাপে তিনি জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেন এবং ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে যখন তাঁর জন্মশতবার্ষিকী পালিত হচ্ছিল ততদিনে তিনি বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয়তম কবিতে পরিণত হয়েছেন। তিনি প্রধানত কবি হলেও বেশ কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা ও প্রকাশ করেছেন। তবে ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের ২২ অক্টোবরে (৫ কার্তিক, ১৩৬১ বঙ্গাব্দ) অকাল মৃত্যুর আগে তিনি নিভৃতে ১৪টি উপন্যাস এবং ১০৮টি ছোটগল্প রচনা গ্রন্থ করেছেন যার একটিও তিনি জীবদ্দশায় প্রকাশ করেননি। তাঁর জীবন কেটেছে চরম দারিদ্রের মধ্যে। বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধকাল অনপনেয়ভাবে বাংলা কবিতায় তাঁর প্রভাব মুদ্রিত হয়েছে। রবীন্দ্র-পরবর্তীকালে বাংলা ভাষার প্রধান কবি হিসাবে তিনি সর্বসাধারণ্যে স্বীকৃত। (উৎসঃ উইকিপিডিয়া) বনলতা সেন-জীবনানন্দ দাশ। বনলতা সেন-জীবনানন্দ দাশ।

হাজার বছর ধ’রে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,

সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে

অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে

সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;

আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,

আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন।

চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,

মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ’পর

হাল ভেঙে যে-নাবিক হারায়েছে দিশা

সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,

তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’

পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।

সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন

সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;

পৃথিবীর সব রং নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন

তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;

সব পাখি ঘরে আসে— সব নদী— ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;

থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।

ধান কাটা হ’য়ে গেছে

ধান কাটা হ’য়ে গেছে কবে যেন— খেতে মাঠে প’ড়ে আছে খড়

পাতা কুটো ভাঙা ডিম— সাপের খোলস নীড় শীত।

এই সব উৎরায়ে ওইখানে মাঠের ভিতর

ঘুমাতেছে কয়েকটি পরিচিত লোক আজ— কেমন নিবিড়।

ওইখানে একজন শুয়ে আছে— দিনরাত দেখা হ’তো কতো কতো দিন,

হৃদয়ের খেলা নিয়ে তার কাছে করেছি যে কতো অপরাধ;

শান্তি তবু: গভীর সবুজ ঘাস ঘাসের ফড়িং

আজ ঢেকে আছে তার চিন্তা আর জিজ্ঞাসার অন্ধকার স্বাদ।

কি এক ইশারা যেন মনে রেখে এক-একা শহরের পথ থেকে পথে

অনেক হেঁটেছি আমি; অনেক দেখেছি আমি ট্রাম-বাস সব ঠিক চলে;

তারপর পথ ছেড়ে শান্ত হ’য়ে চ’লে যায় তাহাদের ঘুমের জগতে:

সারা রাত গ্যাসলাইট আপনার কাজ বুঝে ভালো ক’রে জ্বলে।

কেউ ভুল করেনাকো— ইঁট বাড়ি সাইনবোর্ড জানালা কপাট ছাদ সব

চুপ হ’য়ে ঘুমাবার প্রয়োজন বোধ করে আকাশের তলে।

এক-একা পথ হেঁটে এদের গভীর শান্তি হৃদয়ে করেছি অনুভব;

তখন অনেক রাত— তখন অনেক তারা মনুমেণ্ট মিনারের মাথা

নির্জনে ঘিরেছে এসে; মনে হয় কোনোদিন এর চেয়ে সহজ সম্ভব

আর-কিছু দেখেছি কি: একরাশ তারা-আর-মনুমেণ্ট-ভরা কলকাতা?

চোখ নিচে নেমে যায়— চুরুট নীরবে জ্বলে— বাতাসে অনেক ধুলো খড়;

চোখ বুজে একপাশে স’রে যাই— গাছ থেকে অনেক বাদামী জীর্ণ পাতা

উড়ে গেছে; বেবিলনে এক-একা এমনই হেঁটেছি আমি রাতের ভিতর

কেন যেন; আজো আমি জানিনাকো হাজার-হাজার ব্যস্ত বছরের পর।

আমাকে

তুমি দেখিয়েছিলে একদিন:

মস্ত বড়ো ময়দান— দেবদারু পামের নিবিড় মাথা— মাইলের পর মাইল;

দুপুরবেলার জনবিরল গভীর বাতাস

দূর শূন্যে চিলের পাটকিলে ডানার ভিতর অস্পষ্ট হ’য়ে হারিয়ে যায়;

জোয়ারের মতো ফিরে আসে আবার;

জানালায়-জানালায় অনেকক্ষণ ধ’রে কথা বলে:

পৃথিবীকে মায়াবীর নদীর পারের দেশ ব’লে মনে হয়।

তারপর

দূরে

অনেক দূরে

খররৌদ্রে পা ছড়িয়ে বর্ষীয়সী রূপসীর মতো ধান ভানে— গান গায়— গান গায়

এই দুপুরের বাতাস।

এক-একটা দুপুরে এক-একটা পরিপূর্ণ জীবন অতিবাহিত হ’য়ে যায় যেন।

বিকেলে নরম মুহূর্ত;

নদীর জলের ভিতর শম্বর, নীলগাই, হরিণের ছায়ার আসা-যাওয়া;

একটা ধবল চিতল-হরিণীর ছায়া

আতার ধূসর ক্ষীরে-গড়া মূর্তির মতো

নদীর জলে

সমস্ত বিকেলবেলা ধ’রে

স্থির।

মাঝে-মাঝে অনেক দূর থেকে শ্মশানের চন্দনকাঠের চিতার গন্ধ,

আগুনের— ঘিয়ের ঘ্রাণ;

বিকেলে

অসম্ভব বিষণ্ণতা।

ঝাউ হরিতকী শাল, নিভন্ত সূর্যে

পিয়াশাল পিয়াল আমলকী দেবদারু—

বাতাসের বুকে স্পৃহা, উৎসাহ, জীবনের ফেনা;

শাদা শাদাছিট কালো পায়রার ওড়াউড়ি জ্যোৎস্নায়— ছায়ায়,

রাত্রি;

নক্ষত্র ও নক্ষত্রের

অতীত নিস্তব্ধতা।

মরণের পরপারে বড়ো অন্ধকার

এই সব আলো প্রেম ও নির্জনতার মতো।

নক্ষত্রের চলাফেরা ইশারায় চারিদিকে উজ্জ্বল আকাশ;

বাতাসে নীলাভ হ’য়ে আসে যেন প্রান্তরের ঘাস;

কাঁচপোকা ঘুমিয়েছে— গঙ্গাফড়িং সে-ও ঘুমে;

আম নিম হিজলের ব্যাপ্তিতে প’ড়ে আছো তুমি।

‘মাটির অনেক নিচে চ’লে গেছো? কিংবা দূর আকাশের পারে

তুমি আজ? কোন্ কথা ভাবছো আঁধারে?

ওই যে ওখানে পায়রা একা ডাকে জামিরের বনে:

মনে হয় তুমি যেন ওই পাখি— তুমি ছাড়া সময়ের এ-উদ্ভাবনে

আমার এমন কাছে— আশ্বিনের এত বড়ো অকূল আকাশে

আর কাকে পাবো এই সহজ গভীর অনায়াসে—’

বলতেই নিখিলের অন্ধকার দরকারে পাখি গেল উড়ে

প্রকৃতিস্থ প্রকৃতির মতো শব্দে— প্রেম অপ্রেম থেকে দূরে।

গভীর অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে জেগে উঠলাম আবার;

তাকিয়ে দেখলাম পাণ্ডুর চাঁদ বৈতরণীর থেকে তার অর্ধেক ছায়া

গুটিয়ে নিয়েছে যেন

কীর্তিনাশার দিকে।

ধানসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়েছিলাম— পউষের রাতে—

কোনোদিন আর জাগবো না জেনে

কোনোদিন জাগবো না আমি— কোনোদিন জাগবো না আর—

হে নীল কস্তুরী আভার চাঁদ,

তুমি দিনের আলো নও, উদ্যম নও, স্বপ্ন নও,

হৃদয়ে যে মৃত্যুর শান্তি ও স্থিরতা রয়েছে

রয়েছে যে অগাধ ঘুম

সে-আস্বাদ নষ্ট করবার মতো শেলতীব্রতা তোমার নেই,

তুমি প্রদাহ প্রবহমান যন্ত্রণা নও—

জানো না কি চাঁদ,

নীল কস্তুরী আভার চাঁদ,

জানো না কি নিশীথ,

আমি অনেক দিন— অনেক অনেক দিন

অন্ধকারের সারাৎসারে অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে থেকে

হঠাৎ ভোরের আলোর মূর্খ উচ্ছ্বাসে নিজেকে পৃথিবীর জীব ব’লে

বুঝতে পেরেছি আবার;

ভয় পেয়েছি,

পেয়েছি অসীম দুর্নিবার বেদনা;

দেখেছি রক্তিম আকাশে সূর্য জেগে উঠে

মানুষিক সৈনিক সেজে পৃথিবীর মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্য

আমাকে নির্দেশ দিয়েছে;

আমার সমস্ত হৃদয় ঘৃণায়— বেদনায়— আক্রোশে ভ’রে গিয়েছে;

সূর্যের রৌদ্রে আক্রান্ত এই পৃথিবী যেন কোটি-কোটি শূয়োরের আর্তনাদে

উৎসব শুরু করেছে।

হায়, উৎসব!

হৃদয়ের অবিরল অন্ধকারের ভিতর সূর্যকে ডুবিয়ে ফেলে

আবার ঘুমোতে চেয়েছি আমি,

অন্ধকারের স্তনের ভিতর যোনির ভিতর অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে

থাকতে চেয়েছি।

হে নর, হে নারী,

তোমাদের পৃথিবীকে চিনিনি কোনোদিন;

আমি অন্য কোনো নক্ষত্রের জীব নই।

যেখানে স্পন্দন, সংঘর্ষ, গতি, যেখানে উদ্যম, চিন্তা, কাজ,

সেখানেই সূর্য, পৃথিবী, বৃহস্পতি, কালপুরুষ, অনন্ত আকাশগ্রন্থি,

শত-শত শূকরের চিৎকার সেখানে,

শত-শত শূকরীর প্রসববেদনার আড়ম্বর;

এই সব ভয়াবহ আরতি!

গভীর অন্ধকারের ঘুমের আস্বাদে আমার আত্মা লালিত;

আমাকে কেন জাগাতে চাও?

হে সময়গ্রন্থি, হে সূর্য, হে মাঘনিশীথের কোকিল, হে স্মৃতি, হে হিম হাওয়া,

আমাকে জাগাতে চাও কেন।

অরব অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে জেগে উঠবো না আর;

তাকিলে দেখবো না নির্জন বিমিশ্র চাঁদ বৈতরণীর থেকে

অর্ধেক ছায়া গুটিয়ে নিয়েছে

কীর্তিনাশার দিকে।

ধানসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়ে থাকবো— ধীরে— পউষের রাতে—

কোনোদিন জাগবো না জেনে—

কোনোদিন জাগবো না আমি— কোনোদিন আর।

You may also like

Leave a Comment