Home Politics ১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচন ও এর ফলাফল

১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচন ও এর ফলাফল

by admin
১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বরের

১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচন ও এর ফলাফল। দেশের এই ভয়ানয়ক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে আসন্ন নির্বাচন স্থগিত রাখার জন্য কোনো

কোনো দলের পক্ষ থেকে দাবি উঠলেও আওয়ামী লীগ কিন্তু আর এক মুহূর্তের জন্যও পশ্চিম পাকিস্তানি শোষক শ্রেণীকে বরদাস্ত করতে

রাজি হয় না। শেখ মুজিব হুমকি দেন, নির্বাচন বন্ধ করলে তিনি দেশে বিপ্লব শুরু করবেন। অবশেষে ৭ই ডিসেম্বরে বহুদিনের প্রতিক্ষিত

পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

আওয়ামী লীগ পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে সারা বাংলাদেশে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বরের

জাতীয় পরিষদে পূর্ব বাংলার ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন তারা লাভ করে। প্রাদেশিক পরিষদেও নির্বাচকমণ্ডলী এই দল সম্পর্কে

অনুরূপ রায় দেয়। পশ্চিম পাকিস্তানে জয়লাভ করে ভুট্টোর পিপল্স পার্টি। তারা ১৪৪টি আসনের মধ্যে ৮৮টি আসনে জয়যুক্ত হয়। দুটি

দলই আঞ্চলিক প্রাধান্য ও আধিপত্য লাভ করে। তারপরের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত। ভুট্টো নিজেকে সারা পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধি বলে

দাবি করেন। শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে তাঁর দৃঢ় অভিমত ব্যক্ত করেন ও তিনি আওয়ামী লীগের ৬ দফা স্বীকার করেননি এবং

আওয়ামী লীগ এর দাবি সংশোধন না করলে তিনি জাতীয় পরিষদ বর্জন করবেন বলে ঔদ্ধত্য ও ভয় দেখালেন।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে ভোট দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব

 এদিকে শেখ মুজিব ৬ দফা ভিত্তিক শাসনতন্ত্র প্রণয়নের প্রশ্নে অটল থাকেন

কারণ জনগণ তাঁকে ৬ দফা কর্মসূচির সপক্ষে সুস্পষ্ট রায় দিয়েছেন। ইতিমধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে গভীর ষড়ষন্ত্র শুরু হয়।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে ভুট্টোর দীর্ঘ আলোচনা হয়। সম্ভবত সেখানে চক্রান্তের নীলনকশা প্রস্তুত হয়। ১৯৭১ সনের জানুয়ারি মাসে

ঢাকায় ইয়াহিয়া-মুজিব বৈঠক হয়। বৈঠকে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের সম্ভাব্য তারিখ সম্পর্কে আলোচনা হয়। আলোচনা

শেষে ১৪ই জানুয়ারি ইয়াহিয়া শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী বলে অভিহিত করেন এবং তাঁর নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা

বলেন, কিন্তু জাতীয় পরিষদের নির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করতে তিনি অসম্মত হন। অতঃপর অনেক তালবাহানার পর ১৩ই ফেব্রুয়ারি

ইয়াহিয়া ঘোষণা করেন যে, ৩রা মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের প্রথম বৈঠক বসবে।

এর পরই শুরু হয় ইয়াহিয়া ভুট্টোর একাধিক গোপন বৈঠক ও ভোজে

 এদিকে লাহোরে ভারতীয় বিমান ‘গঙ্গা’ হাইজ্যাক ও ঢাকায় পরিকল্পনা অনুসারে সরকারি ও আধাসরকারি অফিসে বোমা বিস্ফোরণ

ঘটানো হয়, যাতে অজুহাত দেখানো যায় যে, দেশের পরিস্থিতি সংকটময় এবং ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসার মতো পরিবেশ

নেই। ইতিমধ্যে ২৮শে ফেব্রুয়ারি ভুট্টো দাবি করেন যে, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখতেই হবে। ভুট্টো হুমকি দেন, তাঁর দাবি

অগ্রাহ্য হলে তিনি খাইবার থেকে করাচী পর্যন্ত আগুন জ্বালাবেন। পরদিন ১লা মার্চ, ১৯৭১। ইয়াহিয়া অকস্মাৎ নাটকীয়ভাবে ঘোষণা করেন

যে, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত থাকবে। ইয়াহিয়া খানের এই ঘোষণা প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে সারা বাংলাদেশে

প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের ঝড় ওঠে। অল্পক্ষণের মধ্যে ১৯৬৯ সনের মতো গণ-অভ্যুত্থান শুরু হয়।। ঢাকা নগরী মিছিলের নগরীতে পরিণত

হয়। এইবার স্বাধিকার বা সমঝোতা নয়, স্বাধীনতার সংগ্রাম।

শেখ মুজিব এক সাংবাদিক সম্মেলন ডাকেন

 সেখানে তিনি ইয়াহিয়া খানের একতরফা হঠকারী ঘোষণার তীব্র নিন্দা করেন। সেই দিন তিনি জনগণকে নতুন কর্মসূচি দেন। ২রা ও ৩রা মার্চ হরতাল। ৭ই মার্চ রমনার ময়দানে জনসভা। এই ঐতিহাসিক জনসভায় বঙ্গবন্ধু জনগণকে স্বাধীনতার সংগ্রামের সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছিলেন। শেখ মুজিবের হরতালকে নস্যাৎ করার জন্য সামরিক প্রশাসক শহরে কারফিউ জারি করেন। কিন্তু উজ্জীবিত উত্তেজিত জনতা কারফিউ ভঙ্গ করে। সামরিক বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালায়। বহু লোক হতাহত হয়। ঐদিন (২রা মার্চ) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন প্রাঙ্গণে এক বিরাট ছাত্রসভা হয়। এই সভাতেই সর্বপ্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার জন্য শপথ গ্রহণ করা হয়। উক্ত সভাতেই সর্বপ্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ানো হয়। সংবাদপত্রের উপর সেন্সরশিপ আদেশ জারি হয়।

৩রা মার্চ শেখ মুজিব জনগণকে এক অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন

 সেই দিনই ইয়াহিয়া’ খান ১০ই মার্চ শাসনতান্ত্রিক সংকট ও অচল অবস্থা নিরসনের জন্য ঢাকায় এক নেতৃসম্মেলন আহ্বান করেন। পূর্ব বাংলার সাম্প্রতিক পরিস্থিতি ও সামরিক বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ প্রধান ইয়াহিয়া খানের আমন্ত্রণ প্রত্যাখান করেন। তিনি বলেন, “আমরা গণহত্যাকারীদের সঙ্গে বসতে চাই না।” তিনি সৈন্যদের ব্যারাকে ফিরে যেতে অনুরোধ করেন। অতঃপর ৬ই মার্চ ইয়াহিয়া ঘোষণা করেন, ২৫শে মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে। ঐদিন লে. জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব বাংলার নতুন গভর্নর নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু ঢাকা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি তাঁর শপথ গ্রহণ পরিচালনায় অস্বীকৃতি জানান। গভর্নর পদ শূন্য থাকে।

৭ই মার্চ শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক ভাষণ: ১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বরের

তিনি রেসকোর্স ময়দানে বাংলার জনগণকে স্বাধীনতার সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হতে উদাত্ত আহ্বান জানান। তাঁর ভাষণে তিনি বলেন, “এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” ১৫ই মার্চ শেখ মুজিব বাংলাদেশে অসামরিক প্রশাসন চালু করার জন্য ৩৫টি বিধি জারি করেন। ঐদিন ইয়াহিয়া খান ঢাকা আসেন। তারপর ১০ দিন ধরে আলোচনার নামে চলে সময়ের অবক্ষয় ও প্রহসন। ভুট্টো এই ষড়যন্ত্রে শরিক হন। বলাবাহুল্য, এ সময়ে সামরিক বাহিনী সর্বাত্মক আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। অতঃপর প্রস্তুতি-পর্ব সমাধা হওয়ার পর ২৫শে মার্চ রাত্রে ইয়াহিয়া গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন এবং মধ্যরাত্রি থেকে শুরু হয় ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা নির্মম গণহত্যা অভিযান।

২৫ শে মার্চ, শেখ মুজিবের স্বাধীনতা ঘোষণা

বলাবাহুল্য, এ সময়ে সামরিক বাহিনী সর্বাত্মক আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। অতঃপর প্রস্তুতি-পর্ব সমাধা হওয়ার পর ২৫শে মার্চ রাত্রে ইয়াহিয়া গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন এবং মধ্যরাত্রি থেকে শুরু হয় ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা নির্মম গণহত্যা অভিযান। এই হত্যাভিযানের প্রধান শিকার হয় ছাত্র, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকমণ্ডলী ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণী।  ২৫শে মার্চ শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে পাক বাহিনী। শেখ মুজিব গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে রাতের প্রথম প্রহরেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং ঘোষণা করেন শত্রুমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত এ লড়াই চলবে।  পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ইয়াহিয়া জাতির উদ্দেশ্যে বেতারে ভাষণে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ও শেখ মুজিবকে বিশ্বাসঘাতক বলে অভিযুক্ত করেন।

অতঃপর ২৫শে মার্চ থেকে পরবর্তী নয় মাস স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম।

 সেই সংগ্রামের ইতিহাস স্বাধীনতার সপক্ষে চরম ত্যাগ ও তিতিক্ষার এক গৌরবদীপ্ত কাহিনী। ২৬শে মার্চ স্বাধীনতাকামী বাঙালিরা তাদের সকল নির্যাতন ও শৃঙ্খলাবন্ধন চূড়ান্তভাবে ছিন্ন করার সংকল্প নিয়ে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানের কারাগারে আটক রাখা হয়। সারা বাংলাদেশে প্রতিরোধ ও সশস্ত্র সংগ্রাম জোরদার হয়ে উঠিল। ১৭ই এপ্রিল মুক্ত বাংলার কুষ্টিয়া জেলার আম্র বাগানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র আনুষ্ঠানিকভাবে প্রচারিত হয় এবং মুজিবনগরে অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়।

এর পর শুরু হয় তীব্র গণযুদ্ধ

এই গণযুদ্ধে সর্বাত্মক সমর্থন ও সাহায্য দেয় প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়ন বাঙালিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সমর্থন করে এবং পাকিস্তান সরকারকে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার রাজনীতিক সমাধানের জন্য চাপ দেয়। বাংলাদেশের বহু জনগণ পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের শিকার হয় এবং প্রায় এক কোটি লোক উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। বিশ্ববিবেক এই জঘন্য গণহত্যার তীব্র নিন্দা করে। ডিসেম্বর পর্যন্ত চলে পাকিস্তানি হত্যাযজ্ঞ আর মুক্তি বাহিনীর তীব্র প্রতিরোধ ও সংগ্রাম। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করে। ভারতীয় বাহিনী ও বাংলাদেশের মুক্তি বাহিনীর সম্মিলিত কমান্ড বা মিত্রবাহিনী গঠিত হয়। ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১-এ পাকিস্তান আত্মসমর্পণ করে। বিশ্বের বুকে জন্ম নেয় নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশ।

১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বরের

You may also like

Leave a Comment